Thursday, March 19, 2020

যত দোষ, নন্দঘোষ - কে এই নন্দঘোষ!

আমরা প্রায়ই একটা কথা বলি.." যত দোষ নন্দ ঘোষ।" অপরাধ না করেও যখন কাওকে জোর করে অপরাধী করা হয় , তখনই এই বহুল পরিচিত বাক্যটি ব্যবহার করা হয়। আসলে এই বাক্যটির পিছনের রহস্য কি? কে এই নন্দ ঘোষ? ইতিহাসের পাতা ঘেটে চলুন খুজে ফিরি নন্দ ঘোষকে .........
রাজস্ব আদায়ের দেওয়ান থেকে তিনি নিজ দক্ষতার গুণে হয়েছিলেন ‘মহারাজা’।১৭০৫ সালে বর্তমান বীরভূম জেলার নলহাটি থানার ভদ্রপুর গ্রামে মহারাজ নন্দকুমার জন্মগ্রহণ করেছিলেন।



নন্দকুমারের পিতা পদ্মনাভ রায় আলিবর্দি খাঁ’র আমলে তিনটি পরগনার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন। পিতার কাছ থেকে রাজস্ব সংক্রান্ত কাজ শিখে রাজস্ব বিষয়ে নন্দকুমারও দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। মীর জাফরের আমলে মহারাজা নন্দকুমার মহিষাদল পরগনার দেওয়ান নিযুক্ত হয়েছিলেন। মীরজাফরের চেষ্টায় দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে নন্দকুমার ‘মহারাজা’ উপাধি পেয়েছিলেন। লর্ড ক্লাইভও নন্দকুমারকে সুনজরে দেখতেন। মহারাজা নন্দকুমার ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের প্রচেষ্টায় রাণী সন্তোষপ্রিয়া ও রাণী কৃষ্ণপ্রিয়া ফের তমলুকের জমিদারি ফিরে পেয়েছিলেন।
রাজা নন্দ কুমার ছিলেন নবাব সিরাজ উদ দ্দৌলার অধীনে হুগলীর গভর্ণর এবং লর্ড ক্লাইভের আমলে তিনি ছিলেন `কালো কর্ণেল` নামে অধিক পরিচিত। কারণ তিনি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি বিশেষ ভাবে অনুগত ছিলেন।
ঘটনার সূত্রপাত হয় যেভাবেঃ
১৭৭৫ সালের মার্চে তিনি বৃটিশ প্রিভিকাউন্সিলের সদস্য ফ্রান্সিস এর কাছে একটি চিঠিতে গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংস এর বিরুদ্ধে কিছু দূর্ণীতি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আনয়ন করেন।তিনি উল্ল্যেখ করেন গুরুদাসকে দেওয়ান নিযুক্ত করার বিনিময়ে ১,০৪,১০৫ রুপী এবং মুন্নু বেগমকে নাবালক নবাব মুবারক-উদ-দ্দৌলার অভিভাবক নিয়োগের বিনিময়ে ২,৫০,০০০ রুপী ঘুষ গ্রহণ করেন হেষ্টিংস। কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে ওয়ারেন হেষ্টিংস এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য প্রমানিত হয়। কাউন্সিল ঘুষ হিসাবে গৃহিত টাকা ফেরৎ প্রদানের জন্য ওয়ারেন হেষ্টিংসের প্রতি নির্দেশ দেন।
এই ঘটনার কয়েক মাস পর গভর্ণর জেনারেল এবং বরওয়েল এর উদ্যোগে ফক্স এবং রাধাচরণের সাথে নন্দ কুমারকে ষড়যন্ত্রের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়।ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি নন্দ কুমারের নামে জ্বালিয়াতির মামলা করা হয়। ওয়ারেন হেষ্টিংস এবং কাউন্সিলে তার প্রিয় সদস্য বরওয়েল সুপ্রিম কোর্টে এদের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর অভিমত ব্যক্ত করে। এঘটনায় জনগন মনে করে যে নন্দ কুমারকে হেনস্থা করার জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নন্দকুমারের নামে জালিয়াতির মামলা হয় ব্যংকার বুলকি দাসের কিছু জামিন নামা বা দলিল নিয়ে।মোহোন প্রসাদ এই অভিযোগ উত্থাপন করেন।লী মাইষ্টার ও হাইত ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে গভীর রাত পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করেন এবং তাকে কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দেন। ১৭৭৫ সালের ৭ মে মোহোন প্রসাদ নন্দ কুমারের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে মামলা করবেন মর্মে একটি জামিন নামা প্রদান করেন। তার ভিত্তিতে ৮মে সুপ্রিম কোর্টের সকল বিচারপতির উপস্থিতিতে নন্দ কুমারের বিচার শুরু হয়। বারো জন বিচারকের মধ্যে দু`জন ছিলেন ইউরোপিয়ান এবং বাকি সবাই এই ভারত উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বাস করা ইউরোপিয়ান। নন্দ কুমারের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন থমাস ফেরার।
টানা ৮দিন বিরতিহীন ভাবে বিচার কার্য্য চলে। প্রতিদিন সকাল ৮টায় বিচার বসত আর গভীর রাত পর্যন্ত তা চলতো। নন্দ কুমারের বিচার করার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের নেই মর্মে তার আইনজীবীর এই বক্তব্যকে সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে বিচার কার্য চলতে থাকে। বিচারকদের ভারতীয় জ্ঞ্যনের অজ্ঞতার জন্য বিচার কার্য্য ব্যহত হতো। সব কাগজ পত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হয়েছিল।অনুবাদক ছিলেন ওয়ারেন হেষ্টিংসের ঘনিষ্ট বন্ধু। ১৫ই জুন মধ্যরাত পর্যন্ত এই বিচার কার্য্য চলে এবং আশ্চর্য্যজনক ভাবে প্রধান বিচারক ইমপে (হেষ্টিংসের ঘনিষ্ট বন্ধু) ১৬ ই জুন সকালেই বিচারের সার সংক্ষেপ করেন। আসামী পক্ষের সব যুক্তি প্রত্যাখান করে তিনি বৃটিশ পার্লামেন্টের ১৭২৯ সনে প্রণিত আইন অনুযায়ী নন্দ কুমারকে মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করেন।
নন্দ কুমারের আইনজীবী ১৭৭৫ সালের ১৬ জুন হতে ৪ জুলাই পর্যন্ত নন্দ কুমারের জীবন রক্ষার্থে প্রীভি কাউন্সিলে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল এবং প্রীভি কাউনসিলের রায় না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকরী না করার জন্য দরখাস্ত করেন। সুপ্রীম কোর্ট এই আবেদন প্রত্যখান করেন। নবাব একটি পত্রে প্রীভি কাউন্সিলের রায় না পাওয়া পর্যন্ত দন্দাদেশ না পালনের অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধও প্রত্যাখান করা হয়। অবশেষে ১৭৭৫ সালের ৫ই আগষ্ট সকাল ৮ টায় ফোর্ট উইলিয়ামের নিকটবর্তি কুলিবাজারে নন্দ কুমারের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়।
আপনার মতামত জানাবেন।আর বহুল আলোচিত বিষয়ে গুলো নিয়ে আমারা আরও জানবো 

Labels: